working to establish khilafah

NRC ও CAA ইস্যুতে ভারত উত্তাল: সমস্যা ও সমাধান

গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ এ ভারতের সংসদে Citizenship Amendment Act (CAA) বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইন হিসেবে পাশ হয়েছে। এটি ১৯৫৫ সালের নাগরিক আইনের সংশোধন। এই সংশোধিত আইনের মূল কথা হচ্ছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত অবৈধ অধিবাসীদের মধ্যে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মাম্ববলী বা অবৈধ অভিবাসীরা যদি ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে তবে তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত।
তবে মুসলিমদের জন্য এরকম কোন সুযোগ রাখা হয়নি অর্থাৎ এই তিন দেশ থেকে আগত মুসলিমরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী যেমন, ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা মুসলিমগণ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা শরণার্থী।
National Register of Citizens (NRC) বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি হচ্ছে ভারত ও ভারতের বাহিরে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের তালিকা যা আসামে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিজেপি সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে সমগ্র ভারতে  NRC বাস্তবায়ন করা। NRC এর মূল কথা হচ্ছে পূর্বপুরুষ ভারতে বসবাস করার বিষয়ে যদি কেউ উপযুক্ত দলিল প্রমাণ পেশ করতে না পারে তবে সে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।
আসামের চূড়ান্ত NRC তালিকা (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) থেকে যে ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছে তাদের ১৪ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাকি ৫ লক্ষ মুসলিম। আসাম প্রেক্ষাপটে NRC ২০১৯ এবং CAA ২০১৯ এর সমন্বয় করলে ফলাফল হচ্ছে NRC ২০১৯ থেকে বাদ পড়া ১৪ লক্ষ হিন্দু CAA ২০১৯ এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব ফিরে পাচ্ছে আর ৫ লক্ষ মুসলিম হচ্ছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ভারতের কুটনৈতিক ভাষায় এরা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক যারা অবৈধভাবে আসামে বসবাস করছে। NRC ২০১৯ এবং CAA ২০১৯ এর সমন্বিত ফলাফল আসামে প্রত্যক্ষ করার পর ভারতে অবস্থানরত মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ফলতঃ অস্তিত্বের প্রয়োজনে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।
জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত দূর্বলতা হচ্ছে এই রাষ্ট্র ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে একটি সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করার সক্ষমতা রাখেনা যার প্রমাণ হচ্ছে চীন ও ভারতের শাসকশ্রেণীর মুসলিমবিদ্বেষী তৎপরতা।
ইসলাম নির্দিষ্ট সীমানা কেন্দ্রিক জাতি রাষ্ট্রের চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করে। খিলাফত রাষ্ট্র কাঠামোর মাধ্যমে ইসলাম মতাদর্শ হিসেবে বাস্তবায়িত হয়। নাগরিকত্ব ইস্যুতে আমাদেরকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হবে যা আসন্ন খিলাফত অনুসরণ করবে।
১. খিলাফত রাষ্ট্রে ‘সংখ্যালঘু’ নামক কোন Concept নাই।  কোন অমুসলিম যদি খিলাফত রাষ্ট্রে এসে বসবাস করতে চায় তবে তাকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে এবং নিরাপত্তা দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন: “ইমাম (তথা খলীফা) হচ্ছে অভিভাবক এবং সে তার আওতাধীন নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল” (মুসলিম এবং বুখারী উভয়ে একমত)। এখানে “নাগরিক” শব্দটি সার্বজনীন এবং এর মধ্যে মুসলিম ও অমুসলিম অন্তর্ভূক্ত। একইভাবে, নাগরিকত্বের সাথে সম্পর্কিত সকল সাধারন দলিলসমূহ নির্দেশ করে যে, মুসলিম ও অমুসলিম, আরব ও অনারব এবং সাদা ও কালোর ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরন করা নিষিদ্ধ। বরং, ইসলামী নাগরিকত্ব বহনকারী সকল ব্যক্তির বিষয়াদি দেখাশোনার কাজে ও তাদের জীবনের, সম্মানের ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শাসক, কিংবা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে বিচারক, কোনরূপ বৈষম্য না করে সকলের ক্ষেত্রে সমান আচরণ করবে। এছাড়াও তাদের সাথে দয়া, ধৈর্য্য এবং ক্ষমাশীল আচরন করতে হবে। তারা চাইলে ইসলামী সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে পারে এবং মুসলিমদের পাশে থেকে যুদ্ধ করতে পারে।
২. মানুষকে তার বাসস্থান থেকে উৎখাত করা শরিয়াহতে নিষিদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্রে জিম্মিগণ তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং নিরাপদে বসবাস করবে। জিম্মি হলো সেইসব ব্যক্তি যারা ইসলাম ব্যতিত অন্য দ্বীনকে আঁকড়ে থাকে এবং ইসলাম ভিন্ন অন্য বিশ্বাসকে ধারন করে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হয়। জিম্মি শব্দটি জিম্মাহ্ শব্দ থেকে উদ্ভুত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শপথ বা ওয়াদা। অর্থাৎ, জিম্মি হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যাদেরকে আমরা শান্তি চুক্তি মোতাবেক আচরন করার এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের বিষয়াদি দেখাশোনা করার ও মেলামেশা করার ওয়াদা প্রদান করেছি। জিম্মিদেরকে তাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে বাধা প্রদান করা যাবে না, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা:)-এর বক্তব্য আবু উবায়েদ, উরওয়া হতে আল-আমওয়াল-এ বর্ণনা করেছেন: রাসূলুল্লাহ্ (সা:) ইয়েমেনের লোকদের উদ্দেশ্য করে লেখেন: “ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মমতে বিশ্বাসী মানুষদের উপর বল প্রয়োগ করে বিশ্বাস পরিত্যাগে বাধ্য করা যাবে না”
৩. ইসলাম জিম্মাহ্ চুক্তির অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক বিধান প্রদান করেছে, যেগুলোতে তাদেরকে নাগরিকত্বের অধিকার প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে এবং তাদের উপর এর দায়িত্বসমূহ অর্পণ করা হয়েছে। জিম্মিদের বিষয়াদি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এবং লেনদেন ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব না করে শাসক এবং বিচারকগণ জিম্মিদের প্রতি মুসলিমদের মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। সুতরাং মুসলিমদের মতো জিম্মিরাও সমভাবে একই অধিকার ভোগ করে থাকে এবং এটা তাদের কাছ থেকে আশা করা হয় যে, তারাও তাদের উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পালন করবে, উদাহরণস্বরূপ: ওয়াদা পূরন ও রাষ্ট্রের আদেশ পালন। এটাকে এভাবে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বহনকারীদের বিষয়াদিসমূহ যথাযথভাবে দেখাশোনা করা হবে এবং এক্ষেত্রে তারা মুসলিম নাকি অমুসলিম সেটা কোন বিচার্য বিষয় নয়। যারা ইসলামী নাগরিকত্ব অর্জন করবে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন করা নিষিদ্ধ, কারণ শাসন ও বিচার এবং বিষয়াদি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দলিল-প্রমানসমূহের সার্বজনীনতা এটাই নির্দেশ করে। ইসলাম এরকম একটি রূপরেখা প্রদান করে যে, জিম্মিরা আমাদের মতো একই অধিকার ভোগ করবে এবং আমাদের মতো একই আইন মেনে চলবে। তারা ন্যায়-বিচার ও সম অধিকার ভোগ করবে- এ বিষয়টি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র বানী হতে সাধারন আদেশ হিসেবে উদ্ভুত হয়েছে: “এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক বিচার করবে।” [সূরা নিসা: ৫৮]  এটা একটা সাধারণ নির্দেশনা যা মুসলিম ও অমুসলিম সকল মানুষের উপর প্রযোজ্য। এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেছেন: “এবং তোমরা অবিচল থাকবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানের ব্যাপারে; এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কখনও ন্যায়বিচার বর্জন করতে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করবে, এটাই ত্বাকওয়ার নিকটবর্তী” (মায়িদাহ্:৮), এবং কিতাবধারী ব্যক্তিদের মধ্যে ন্যায়বিচারের বিষয়ে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র বাণী থেকেও এটা স্পষ্ট হয়: “আর যদি বিচার ফয়সালা করেন তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ভাবে বিচার করবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন” (মায়িদাহ:৪২)।
পরিশেষে বলবো, সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ তথা কাশ্মীর, বাবরী মসজিদ এর ইস্যুগুলো একের পর এক এসে আমাদের জানান দিচ্ছে যে তথাকথিত সেকুলার জীবনব্যবস্থা সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ। শুধুমাত্র ভারতে কেন, সারাবিশ্বেই একই চিত্র। একমাত্র ইসলামই হচ্ছে সে আদর্শ যা অতীতে সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল এবং চাইলে আজও পারবে। সুতরাং, আসুন আমরা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রামে এগিয়ে আসি যা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে আহ্বান করবে। মুসলিমবিদ্বেষী ভারতীয় মুশরিক শাসকদের নিপীড়ন থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্ত করবে এবং ভারতকে পুনরায় ইসলামের পূণ্যভুমিতে রুপান্তর করবে ইনশাআল্লাহ্। আবু হুরায়রাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেন:
“অবশ্যই তোমাদের মধ্যে একটি সেনাবাহিনী হিন্দুস্তানের (ভারত) সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ্ সেই বাহিনী যোদ্ধাদের বিজয় দান করবেন। তারা হিন্দুস্তানের শাসকদের বেড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসবে। আল্লাহ্ সেই বাহিনী যোদ্ধাদের মাগফিরাত দান করবেন…” [কিতাবুল ফিতান]