“হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি: চ্যালেঞ্জ ও পুনরুদ্ধারের উপায়” শীর্ষক সেমিনারে হিযবুত তাহ্রীর, উলাই‘য়াহ্ বাংলাদেশ-এর সদস্যের বক্তব্য, যিনি Bangladesh Policy Discourse (BPD) কর্তৃক আয়োজিত এই সেমিনারটিতে অন্যতম একজন অতিথি বক্তা ছিলেন
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
“হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি: চ্যালেঞ্জ ও পুনরুদ্ধারের উপায়” শীর্ষক সেমিনারে হিযবুত তাহ্রীর, উলাই‘য়াহ্ বাংলাদেশ–এর সদস্যের বক্তব্য, যিনি Bangladesh Policy Discourse (BPD) কর্তৃক আয়োজিত এই সেমিনারটিতে অন্যতম একজন অতিথি বক্তা ছিলেন
আজ শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪ তারিখে বিকাল ৩ ঘটিকায় ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি, নসরুল হামিদ মিলনায়তন-এ বাংলাদেশ পলিসি ডিসকোর্স কর্তৃক আয়োজিত “হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি: চ্যালেঞ্জ ও পুনরুদ্ধারের উপায়” শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত হিযবুত তাহ্রীর, উলাই‘য়াহ্ বাংলাদেশ–এর সদস্য জনাব কাজী রিয়াদ তার বক্তব্যে যে বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন তার সারমর্ম নীচে দেয়া হলো:
হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি এই মুহুর্তে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: ১। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ২। শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সংকট ৩। রিজার্ভ সংকট ও ঋণ পরিশোধের চাপ ৪। আমেরিকান তেল–গ্যাস কোম্পানির নিকট দেনা ৫। আমদানি ও ঋণ নির্ভর অর্থনীতি। বর্তমান অর্থনৈতিক এই চ্যালেঞ্জসমূহ জরুরী ভিত্তিতে মোকাবেলা করা প্রয়োজন, যাতে জনগণের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পতিত হাসিনা সরকারের মতই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী FDI বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিচ্ছে, জ্বালানী খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা এবং জনগণের উপর করের পরিধি বৃদ্ধি করছে। যার ফলে জনগণের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতি আরও ঋণ ও পরনির্ভর হয়ে দেউলিয়াত্বের দিকে ধাবিত হবে।
বর্তমান সংকট মোকাবেলায় ইসলামী অর্থনৈতিক নীতি ও শারীআহ্ বিধানের আলোকে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী, যার মাধ্যমে জনজীবনে দ্রুত স্বস্তি ফিরে আসবে, ইনশা‘আল্লাহ্।
১। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে জনগণকে রেহাই দিতে অনতিবিলম্বে আমদানিকৃত পন্যের উপর সকল শুল্ক এবং ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার করা আবশ্যক। শারী‘আহ্ আইন মোতাবেক এই জাতীয় শুল্ক আরোপ করা নিষেধ। উকবা বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ট্যাক্স গ্রহণকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না”[মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ]। ফলে দ্রব্যমূল্যের উপর এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে, অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য কমে আসবে।
২। যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের মুল্য সর্বনিম্ন, তখন জ্বালানী উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে তেলের মূল্য নামকাওয়াস্তে ছয় টাকা কমিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন। কিন্তু জ্বালানী ও বিদ্যুতের উপর যে ৩৭% ভ্যাট-ট্যাক্স বহাল আছে তা কেন জ্বালানী উপদেষ্টার চোখে পড়ছে না। তাই অনতিবিলম্বে এই ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। যার তাৎক্ষনিক সুফল হিসেবে দেশের শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় দ্রুত কমে যাবে এবং মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। শিল্প কারখানা ও দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
৩। কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো বিগত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুট করেছে। তাই এজাতীয় সকল বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে এবং এগুলোর সুবিধা জনগণের মধ্যে স্বল্প মুল্যে বণ্টন করতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ গণমালিকানাধীন সম্পদ এবং এই সম্পদসমূহ বেসরকারীকরণ করা হারাম। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন, “মুসলিমরা (জনগণ) পানি, চারণভূমি এবং আগুন এই তিনটি জিনিসের অংশীদার” (আবু দাউদ)। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবনে আব্বাস আরও যোগ করে বলেন, “এবং এর মূল্য গ্রহন করা হারাম (নিষিদ্ধ)”। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নীতি অনুসরণ করে জনগণের সম্পদ (গণমালিকানাধীন সম্পদ) যা ইজারা বা বেসরকারীকরণ করা হয়েছে, তা ইসলামী শারী‘আহ্ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ইসলামের এই নীতি অনুসরণের ফলাফল হিসেবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে এবং এর সাথে উৎপাদনের খরচ হ্রাস পাবে, দ্রুত শিল্পায়ন হবে।
৪। হাসিনা সরকার দুর্নীতির উদ্দেশ্যে এবং তার বিদেশী প্রভূদের আশীর্বাদে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারতীয় আদানির সাথে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি এবং রাশিয়ার রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চুক্তি করেছে। এসব কোম্পানীসমূহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে ঋণের কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। অথচ, সরকারের উচিত পাল্টা তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা, কারণ ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিগত অবৈধ সরকার তাদের সাথে নানা অবৈধ চুক্তি সম্পাদন করেছে, যার কোন স্বচ্ছতা নেই। এসব প্রকল্পগুলো দুর্নীতিতে ভরপুর এবং সুষ্ঠু তদন্ত সম্পন্ন করে তাদের থেকে উল্টো ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত। এসব চুক্তিসমূহ পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে এবং পতিত হাসিনার পৃষ্টপোষক এসব দেশের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
৫। বঙ্গোপসাগরের ১৫ টি হাইড্রোকার্বন ব্লক আমেরিকার ExxonMobil-কে ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়াধীনে ছিল, এই লক্ষ্যে পতিত হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবানও করেছিল। অবিলম্বে দরপত্র বাতিল করতে হবে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে BAPEX-কে নিয়োজিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ-জনবল-প্রযুক্তি দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে।
৬। স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য দ্রুত শিল্পায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নব্য উপনিবেশবাদী মুক্তবাজার ও বেসরকারীকরণ নীতি প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং বহুজাতিক কোম্পানীসমূহকে উচ্ছেদ করতে হবে।
৭। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানী যেমন: শেভরন ও কনকোফিলিপস-এর মতো কোম্পানীসমূহকে উচ্ছেদ করতে হবে। তারা প্রোডাকশন এণ্ড শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট তথা পিএসসি চুক্তির সুযোগ নিয়ে আমাদের তেল, গ্যাস উত্তোলন করে আমাদের কাছেই আন্তর্জাতিক মূল্যে বিক্রি করে। এর পরিবর্তে ইসলামের জ্বালানী নীতির মডেল বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮। আইএমএফ–বিশ্বব্যাংক-এর মত পশ্চিমাদের নব্য উপনিবেশবাদী সংস্থার হস্তক্ষেপ দেশের অর্থনীতিতে বন্ধ করতে হবে। এদের পরামর্শই আমাদের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা। একদিকে তারা খুবই নন-প্রোডাক্টিভ খাতগুলোতে ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে, যার সুদ-আসল জনগণকে বহন করতে হচ্ছে; অপরদিকে কৃষিতে ভর্তুকি তুলে নেয়া এবং ভারী শিল্পায়নে নীরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়ে তারা আমাদের অর্থনীতিকে করেছে ভঙ্গুর। আফ্রিকার বহু দেশ তাদের পরামর্শে আজ হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সাবধান করে বলেন, “আর কিছুতেই আল্লাহ্ মুমিনদের ওপর কাফেরদের কর্তৃত্ব মেনে নিবেন না” (সূরা নিসা: ১৪১)
৯। সমর ভিত্তিক ভারী শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আর প্রস্তুত কর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী, যা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহ্’র শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং এরা ছাড়া অন্যদেরকেও, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না, আল্লাহ্ তাদেরকে জানেন” [সূরা আল-আনফাল: ৬০]। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরও বলেন, “আর আমি অবতীর্ণ করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী” (সূরা হাদিদ: ২৫)। এ দুটি আয়াত সহ আরো অনেক আয়াত এবং হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ভারী সমরভিত্তিক অর্থনীতি ও রাষ্ট্র গঠনের, যা একদিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে, অন্যদিকে লোহাজাত নানান শিল্প তৈরি হবে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
১০। ডলারের আধিপত্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ইসলামের অর্থনৈতিক মডেল অনুযায়ী গোল্ড এবং সিলভার ভিত্তিক মুদ্রা প্রচলন করতে হবে। যার ফলে পৃথিবীর অনেক দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করতে চাইবে এবং আমরা একটি নেতৃত্বশীল জাতিতে পরিণত হব, ইনশা‘আল্লাহ্।
সর্বোপরি, ইসলামের অর্থনীতির মডেল পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব খিলাফত ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাই নবুয়তের আদলে খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে, যার মাধ্যমে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নেতৃত্বশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবো, ইনশা‘আল্লাহ্। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আর যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমীনের যাবতীয় বরকতসমূহের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতাম…” (সূরা আল আরাফ: ৯৬)
হিযবুত তাহ্রীর / উলাই‘য়াহ্ বাংলাদেশ-এর মিডিয়া অফিস