অনেক ত্যাগের বিনিময়ে যালিম হাসিনার পতন হলেও বর্তমান স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের রাজনীতিতে জনগণ হতাশ
ইসলাম, জনগণের স্বার্থ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ভিত্তিতে রাজনীতিই
জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে
যালিম হাসিনা জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। তার সরকারের পতনের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে, নতুন বাংলাদেশ গঠনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, বিশেষ করে কালো আইনসমূহ বাতিল হবে, দেশবিরোধী চুক্তিসমূহ বাতিল হবে, এবং সর্বোপরী ইসলামবিরোধী নীতিতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু, জনগণ প্রত্যক্ষ করছে, অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সাথে বিভিন্ন দেশবিরোধী চুক্তিসমূহ বাতিল না করে হাসিনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে; ইরাক-আফগানিস্তান সহ বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের গণহত্যাকারী এবং ফিলিস্তিনে অভিশপ্ত ইহুদীগোষ্ঠীর গণহত্যায় মদদদাতা মার্কিনীদের এদেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং তাদের “ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের” ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছে। সর্বশেষ, মার্কির্নীদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যার সহযোগী মার্কিন মদদপুষ্ট আরাকান আর্মিকে সাহায্যের লক্ষ্যে ‘মানবিক করিডোর’ বা ‘মানবিক চ্যানেল’ প্রতিষ্ঠার এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল মার্কিন প্রভাবাধীন কোম্পানী ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’-এর কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
হে সচেতন জনগণ, নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ! আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ‘জনগণের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয় (The state is a means, not an end)’। রাষ্ট্রের অস্তিত্বই হচ্ছে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য। এই লক্ষ্যে তিনটি মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। এক, জনগণের মৌলিক বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে রক্ষা করা; দুই, জনগণের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তা সহ মৌলিক অধিকারসমূহ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; এবং তিন, বহিঃশক্তির আধিপত্য থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কেউ কেউ প্রচার করে, বহিঃশক্তি যদি বন্ধু রাষ্ট্র হয়, তাহলে তাদের আধিপত্য আমাদের জন্য কল্যাণকর। প্রকৃতপক্ষে, বহিঃশক্তির আধিপত্য যদি বিদ্যমান থাকে, তাহলে জনগণের প্রথম দু’টি বিষয়ও ভূলণ্ঠিত হয়ে যায়। যেমন, তারা তাদের বিশ্বাস ও আদর্শ (ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদ) এদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয় এবং তাদের (মার্কিন-বৃটেন-ভারত) স্বার্থ জনগণের উপর প্রাধান্য পায়। রাষ্ট্র তখন জনগণকে তত্ত্বাবধান করতে ব্যর্থ হয়। যদি কোন সরকার বা রাজনৈতিক দল এই তিনটি বিষয়ের যেকোন একটি অগ্রাহ্য করে তখন প্রকৃতপক্ষে তারা আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না।
আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন, হাসিনার বিদায়ের পর নতুন আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল এবং পুনর্জীবিত হওয়া পুরাতন দলগুলো জনগণকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে লিপ্ত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব পশ্চিমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। তাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থেকে ইসলামী আক্বিদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্পকে “ধর্মীয় উগ্রতা বা চরম পন্থা” আখ্যা দিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে “ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে” তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে। যারা এদেশের জনগণের ইসলামী বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে তোয়াক্কা করে নাই, তাদের “জুলাই সনদ”-এর আলোকে নতুন বাংলাদেশ কিংবা সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের প্রস্তাবনার বিষয়ে জনগণেরও কোন আগ্রহ নাই। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোন কোন ইসলামী রাজনৈতিক দল পশ্চিমা দূতাবাসসমূহে দৌড়ঝাপ করছে এবং পশ্চিমাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচিত করতে পশ্চিমাদের আকাঙ্ক্ষার আদলে নিজেদেরকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। এছাড়া, যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের নামে ‘রেইনবো নেশন’-এর ধারনাকে গ্রহণ করেছে, তারা কি জানেনা ‘রেইনবো’ হচ্ছে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি LGBTQ-এর প্রতীক, যার মধ্যে সমকামিতার মত নিকৃষ্ট সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত? তারা কি এটাও জানেনা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ-উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা পশ্চিমাদের “ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নীতিকেই সমর্থন করা?
অন্তর্বর্তী সরকার সহ নতুন-পুরাতন রাজনৈতিক দলসমূহের পশ্চিমামুখী নীতি ও স্বার্থের রাজনীতি প্রত্যাশা পূরণের পরিবর্তে জনগণকে হতাশ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতিই জনগণের বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতি, জনগণের স্বার্থ ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। নিঃসন্দেহে, এই রাজনীতিই এদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম:
প্রথমত, ইসলাম একটি আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক আদর্শ, যার উপর ভিত্তি করে মুসলিমদের আবেগ-অনুভূতি ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত। এবং মুসলিম উম্মাহ্ শত শত বছর ধরে ইসলামের ন্যায়পরায়ণ শাসনের অধীনে ছিল। সুতরাং নব্বইভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এই ভুখন্ডে ইসলামী বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে উপেক্ষা করে কোন সরকার অথবা রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। এই বিষয়টি প্রমাণিত সত্য; যে কারণে ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠী জনগণের সমর্থন লাভ করতে সংবিধানে “বিসমিল্লাহ্”, “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম” সংযোগ করে অথবা “কুর’আন-সুন্নাহ্ বিরোধী আইন পাশ করবে না” এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে। হাসিনা পতনের অন্যতম কারণ ছিল সে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পশ্চিমাদের পদানত সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে এবং পশ্চিমাদের নিকট নিজেকে ‘গণতন্ত্রের ক্রুসেডার’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ইমাম (খলিফা) একজন অভিভাবক এবং তিনি তার নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল” [সহীহ্ আল-বুখারী]। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা খলিফার উপর ফরয দায়িত্ব এবং এক্ষেত্রে কখনো ফান্ডের ঘাটতি হলে প্রয়োজনে ধনীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে হলেও রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এছাড়া, খলিফা নাগরিকদের জন্য উন্নত জীবনযাপন অর্জন করার সুযোগ করে দিবেন। ইসলামী ব্যবস্থায় দারিদ্রতার কোন স্থান নাই; আলি (রা.) খলিফার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, “দারিদ্রতা যদি কোন মানুষ হতো, তাহলে আমি তাকে হত্যা করতাম”। অপরদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের, কতিপয় পুঁজিপতির এবং পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে, আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শোষণ করে। আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন, দশকের পর দশক ধরে দুর্নীতিগ্রস্থ শাসকদের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু জনগণের দুর্দশার পরিবর্তন হয় নাই। শাসকগোষ্ঠী জনগণের জন্য উন্নত জীবনযাপনতো দূরের কথা মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণ করতে পারে নাই। উদাহরণস্বরূপ, শাসকগোষ্ঠী চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত বিদেশে বিশেষ করে সিঙ্গাপুর গমন করছে, আর এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা করে রেখেছে।
তৃতীয়ত, আল্লাহ্ (ﷻ) বলেন, “মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, তাদের সাথে আল্লাহ্’র কোন সম্পর্ক থাকবে না” [সূরা আলি-ইমরান : ২৮]। ইসলামের দৃষ্টিতে মার্কিন-বৃটেন-ভারত হলো শত্রু রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রের সাথে করিডোর, বন্দর, সামরিক চুক্তি যেমন: আকসা, জিসোমিয়া এবং সামরিক মহড়া ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। অপরদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে দেশের অর্থনীতি, সার্বভৌমত্ব ও সামরিক বাহিনীর উপর পশ্চিমাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে। আপনারা প্রত্যক্ষ করছেন, মার্কিন অনুগত রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠী ভারতের আধিপত্য মোকাবেলা করার অজুহাত দিয়ে মার্কিনীদের আধিপত্যকে জায়েজ করার অপচেষ্টা করছে। অথচ, ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট কোয়াড (QUAD)-এর সদস্য। আরব ভূখন্ডে দখলদার ইসরায়েল যেমন মার্কিনীদের স্বার্থরক্ষা করে, তেমনি এই অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ভারত মার্কিনীদের স্বার্থরক্ষার চৌকিদার। সুতরাং, এই অঞ্চলে মার্কিনীদের আধিপত্য মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে ভারতের আধিপত্য মেনে নেয়া।
হে দেশবাসী! ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদ একটি মানবরচিত ও ত্রুটিপুর্ণ ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থা বিগত একশ বছরে বিশ্বে অপসংস্কৃতি, দুঃশাসন-দুর্নীতি, যুলুম-অত্যাচার ছড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই হচ্ছে হাসিনার মত যালিম তৈরির কারখানা। বর্তমান সংস্কারের আলোচনা হলো এই ব্যর্থ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অপকৌশল। আল্লাহ্ (ﷻ) বলেন, “আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, ‘আমরা তো কেবল সংস্কারকারী’।” [সূরা আল-বাকারাহ্ : ১১]। সর্বোপরী, সেকুলার-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলামের আক্বীদা পরিপন্থী, যার অধীনে জীবনযাপন করা মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই মুসলিম অধ্যুষিত এই ভূখন্ডে ইসলামের ভিত্তিতে রাজনীতিই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।
হে সচেতন জনগণ, নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ! ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতিকে ন্যায়পরায়ণ শাসনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। খিলাফত রাষ্ট্র হাজার বছর বিশ্বে নেতৃত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিদ্যমান ছিল এবং বিশ্বকে আলোকিত করেছিল। আল্লাহ্ (ﷻ) বলেন, “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির জন্য; তোমরা সৎকাজে আদেশ করো, অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং আল্লাহ্’র উপর দৃঢ় ঈমান রাখো” [সূরা আলি-ইমরান : ১১০]। এই জাতি কিভাবে পশ্চিমাদের পঁচে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মেনে নিবে? কোন সাহসে পশ্চিমাদের অনুগতগোষ্ঠী আমাদের জনগণের উপর ইসলামবিরোধী এই ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে? তাই সচেতন জনগণ, নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবীদের নিকট হিযবুত তাহ্রীর-এর উদাত্ত আহ্বান, আপনারা পশ্চিমাদের দেউলিয়াগ্রস্থ ধর্মনিরপেক্ষ-পুঁজিবাদী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে আপনাদের রাজনীতি পরিচালনা করুন এবং নবুয়তের আদলে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলুন।
“এবং তোমরা সকলে আল্লাহ্’র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, পর¯পর বিভক্ত হয়ে যেওনা” [সূরা আলি-ইমরান : ১০৩]
শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
০২ জিলহজ্ব, ১৪৪৬ হিজরী