হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হলেও, হাসিনাকে জন্ম দেয়া যুলুমের ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

بسم الله الرحمن الرحيم

হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হলেও, হাসিনাকে জন্ম দেয়া যুলুমের ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আই.সি.সি) ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে। দেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য এই রায় বহুদিনের প্রাপ্য প্রতীকী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেই শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অভিযোগ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যা মৌলিক মানবিকতাকে পিষ্ট করেছিল। কিন্তু এই রায় কেবল উদযাপন নয়, বরং গভীর চিন্তা-ভাবনার দাবী রাখে। সত্যিকারের ন্যায়বিচারের জন্য শুধুমাত্র একজন যালিম স্বৈরশাসকের শাস্তি নয়, বরং ব্যবস্থাগত পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ এর মূলে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা, যা গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু ‘ভূ-রাজনৈতিক বাস্তববাদ’ (geopolitical pragmatism) এর চর্চা করে। পশ্চিমা শক্তিগুলো অব্যাহতভাবে মানবাধিকারের চেয়ে ‘স্থিতিশীলতা’ এবং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে, এবং উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কিংবা মিশরের মতো দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ন্যায্যতা প্রদান করে আসছে। তাদের নিকট অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত ফলাফল নির্ভর গণতন্ত্রের চেয়ে, একজন পশ্চিমাপন্থী একনায়কই সর্বদা বেশী পছন্দের। এটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মডেলের মৌলিক ভণ্ডামীকে উন্মোচন করে: “কথায় গণতন্ত্র, কিন্তু কাজে একনায়কত্ব”। স্বৈরশাসকদের সাথে তাদের এই মৈত্রী, কোনো ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা নয় – বরং এটি নিজেই সেই ব্যবস্থা।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই রায়টি তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এটি এককভাবে প্রকৃত মুক্তি নিশ্চিত করে না। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামকে ব্যক্তি স্বৈরশাসককে অপসারণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না, বরং এটিকে স্বৈরশাসকদের জন্মদানকারী ভণ্ডামীপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলার দিকে ধাবিত করতে হবে। মুলতঃ ১৯২৪ সালে খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংসের পরে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূণ্যতার প্রত্যক্ষ পরিণতি হচ্ছে- স্বৈরশাসকদের জন্ম দেয়া এবং অপসারণ করার এই রীতি; কারণ সেই শূণ্য স্থানটি দখল করে নেয় পশ্চিমাদের পরিকল্পিত ব্যবস্থা- যা নিয়ন্ত্রণকে ন্যায়বিচার ও বিবেকের চেয়ে প্রাধান্য দেয়।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পশ্চিমা শক্তিসমূহ, খিলাফত ধ্বংসের পর থেকে এর প্রত্যাবর্তনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও অসম্মানিত করতে অব্যাহতভাবে মিথ্যা রচনা বা আখ্যান তৈরি করেছে, যেখানে তারা এটিকে ১৪০০ বছরের নিপীড়নের বিশাল এক অখণ্ড চিত্র হিসাবে উপস্থাপন করে। এই প্রাচ্যবাদী (Orientalist) মিথ্যা আখ্যান একদিকে বেছে বেছে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কিংবা কয়েকজন মামলুক সুলতানের মতো নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে, আর অন্যদিকে সেইসব সুমহান শক্তিশালী আইনী ও নৈতিক কাঠামোগুলোকে পরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যায় যা স্বৈরাচার তৈরির পথ রুদ্ধ করেছিল। উসমানী খিলাফত “ন্যায়বিচার বিভাগ” (দায়েরা-ই আদলিয়ে) নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হত, যা স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনকল্যাণের সাথে যুক্ত করত। সুলতান সুলেমান পদ্ধতিগতভাবে আইন সংগ্রহের (systematic legal codification) কারণে “আল-কানুনী” উপাধি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কার উসমানী মিল্লাত ব্যবস্থা (Millet System) ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্ব-শাসন মঞ্জুর করেছিল, এবং সেসময়ে স্বাধীন আলেমগণ (উলামা) এবং শারীয়াহ্ আইন, খলিফার কর্তৃত্বকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে স্থায়ী পর্যবেক্ষক ও সীমারেখা নির্ধারক হিসাবে ভূমিকা পালন করতো। জবাবদিহিতার নীতিটি ঐতিহাসিক কোর্ট অফ ইনজাস্টিস এক্টস্” (মাহকামাত আল-মাযালিম)-এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, যা নাগরিকদেরকে ক্ষমতাশালী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনী প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ দিত। যদিও খুলাফায়ে রাশিদীন আমাদের আদর্শ, তথাপি পরবর্তী খিলাফতগুলোকেও পশ্চিমা কল্পকাহিনীতে যেভাবে সরাসরি অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত সত্য হলো, সেগুলো ছিল জটিল ব্যবস্থা, যাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া বিদ্যমান ছিল।

হে দেশবাসী, আপনাদের প্রচেষ্টাকে কেবলমাত্র একজন স্বৈরশাসকের পতনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, বরং এটিকে এই গণ্ডির বাইরে নিতে হবে, এবং যে ব্যবস্থার গর্ভে তাদের জন্ম তা থেকে চিরতরে মুক্তির দিকে ধাবিত করতে হবে। কেবলমাত্র চেহারার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃত ও স্থায়ী পরিবর্তন অর্জন সম্ভব নয়, বরং তা  খিলাফতের অধীনে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত শাসন বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত রয়েছে। সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ্ ﷻ কর্তৃক পরিকল্পিত এই ব্যবস্থাটিই পারে মূল থেকেই স্বৈরাচারকে নির্মূল করতে, ক্ষমতার উপর অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা প্রতিষ্ঠা করতে, এবং সকলের জন্য ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে। এখন সংগ্রাম হচ্ছে এই পরিবর্তন আনার — মানুষের ভ্রান্ত, নিপীড়নমূলক মডেলগুলোকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রদত্ত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ ﷻ পবিত্র কুর‘আন-এ বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের সেই আহ্বানে সাড়া দাও, যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহ্বান করা হয়, যা তোমাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে” [সূরা আল-আনফাল: ২৪]

 

 

হিযবুত তাহ্রীর, উলাই‘য়াহ্‌ বাংলাদেশএর মিডিয়া অফিস